Essay Writing




Powered by Froala Editor

শিক্ষাগুরুর অবদান

Powered by Froala Editor

বর্ণমালার প্রথম বর্ণটির উচ্চারণ করতে পারা সহজ নয়। এর পেছনে আছে শিক্ষক, পিতা-মাতার অক্লান্ত প্রচেষ্টা। ধীরে ধীরে সকল বর্ণ চিনতে পারা, পড়তে পারা, কার, ফলা, বিরাম চিহ্ন ইত্যাদি আয়ত্বে আসে। প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলে লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। দুচারটি টঙ দোকান নিয়ে ছিলো বাজার। বাজারের পাশে স্কুল। দোকানে রঙবেরঙের ভুনভুনি, ঘাসের দুধ, নাবিস্কো চকলেট, ছোন পাপড়ি এরকম হাতে গোনা কয়েকটা খাবার পাওয়া যেত। প্যাকেটের লেখাগুলো বানান করে করে পড়তে চেষ্টা করতাম।

স্কুলের পথে রিকশা চলত। রিকশাচিত্র আমাদের কাছে খুব আকর্ষনীয় ছিল। গাঢ় উজ্জ্বল রঙের হাতে আঁকা ছবি থাকত। রিক্সার দুইপাশে, সামনে বাঁধাই করা ভিউ কার্ড থাকত। কবরী, সাবানা, ববিতা, দিতি, চম্পা যার যে নায়িকা প্রিয় তার ভিউ কার্ড থাকত। রিকসার পেছনে সুন্দর সুন্দর রিকশালিপি ছিলো। অনেক কিছু লেখা থাকত। "মা", "মায়ের দোয়া", "দশে মিলে করি কাজ", 'ছোট পরিবার সুখী পরিবার' ইত্যাদি। এক একটা লেখা যেন একএকটা গল্প, সমাজচিত্র। লেখা গুলো বানান করে পড়তাম। শুরুতে পুরো বাক্য বানান করতে না করতেই দূরে চলে যেত। শহরে বেড়াতে গেলে দোকানের সাইন বোর্ডের লেখা বানান করতাম।  প্রতিনিয়ত দক্ষতা বাড়তে থাকে। আজ পলকের মধ্যে বড় বড় বাক্য পড়ে ফেলি। তার মর্মার্থ উদ্ধার করে ফেলি। যার সূচনা হয়েছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সেই শিক্ষকদের হাত ধরেই। যারা অসীম ধৈর্য, মেধা, শ্রম দিয়ে প্রথম বর্ণটি উচ্চারণ করতে শিখিয়েছেন। 

বাংলা বিষয়ের স্যার যখন নেচে নেচে 'আমাদের গ্রাম' ছড়া পড়ত, তখন মানসপটে গ্রামের ছবি ভেসে উঠত। আমার গ্রামের সাথে কবির অচেনা গ্রামের তুলনা করতাম। তাদের সেই বুদ্ধিদীপ্ত প্রয়াসে আমার ভিতরে বেড়েছে কল্পনা শক্তি, সৃজনশীলতা,  নান্দনিক বোধ।

সমাজবিজ্ঞানের আপা প্রতিদিন বলতেন গুরুজনদের ভক্তি করবে, বড়দের সালাম দেবে, আদেশ মান্য করবে। আরও কত কথা। সেগুলো তখন 'পড়া'র মতো ছিলো। আজ বুঝি, সেগুলো মানুষ গড়ার মন্ত্র ছিলো। ইংলিশের স্যার বলতেন, 'দরিদ্রকে উপহাস কর না', 'চকচক করলেই সোনা হয় না' ট্রান্সলেশন কর। এ সকল পাঠগ্রহণের মধ্যদিয়ে আমাদের ভাষা ও যোগাযোগ দক্ষতার বিকাশ সাধিত হয়েছে।

নিজেকে প্রকাশ করার যোগ্যতা অর্জন করেছি। তারা আমাকে তৈরি করে না দিলে অন্য প্রাণির সাথে আমার প্রভেদ থাকত কি?

'দুয়ে দুয়ে চার হয়' কিংবা 'একের এক নামলে হাতে কিছু থাকে না' বাস্তব দুনিয়ার এত সুগভীর সমীকরণ কত সহজে তারা হৃদয়ে গ্রথিত করে দিয়েছেন।

মন্দ ভালোর পার্থক্য করতে শিখিয়েছেন। 

ক্লাস শুরুর আগে সমাবেশ হত। জাতীয় সঙ্গীত হত। শপথ হত। অন্যকে অগ্রাধিকার দেয়া, পরমত সহিষ্ণুতা,  ত্যাগের মনোভাব, মিলেমিশে বাস করার মানসিকতা গল্পের ছলে অন্তরে গেঁথে দিয়েছেন যারা তারাই মহান শিক্ষাগুরু।

শিক্ষার্থীর অন্তর্নিহিত মেধার বিকাশ ঘটে মাধ্যমিক শিক্ষায়। প্রাথমিক স্তরে অর্জিত মৌলিক জ্ঞান সম্প্রসারিত ও সুসংহত হয়। বড় হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অগাধ জ্ঞান সমুদ্রে অবগাহন করি। জ্ঞানের সেই অন্তহীন সমুদ্রে সাঁতার কাটতে শিখিয়েছেন মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষকরা। তাঁরা যে জ্ঞানের বীজ বপন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচর্যায় তা বিশাল মহীরুহে পরিণত হয়।  সুপ্রবৃত্তি ও কুপ্রবৃত্তির পার্থক্য করতে শিখিয়েছেন। উচিত-অনুচিতের বিচার করতে শিখিয়েছেন। কেউ তার প্রিয় শিক্ষকের মুখ নিসৃত কোন উক্তি-উপদেশকে জীবনের পাথেয় করেছেন। এক শ্রেণির মানুষকে অর্থনীতি ও উৎপাদন স্তরে একটি পর্যায়ের দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিরূপে তৈরি করেন তাঁরা। 

তারপর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সান্নিধ্যে বিকশিত হয় বুদ্ধিচর্চা, মননশীলতা, চিন্তার স্বাধীনতা। পার্থিব-অপার্থিব জ্ঞানের মাধ্যমে বিশ্বব্রহ্মন্ডে যা কিছু  শ্বাশত সত্য আর যা কিছু শ্বাশত মিথ্যা তা চিনতে পারি। অনেকের মধ্যে তুলনা করে  শ্রেষ্ঠটি নির্বাচন করতে পারি। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক সমস্যা সনাক্ত করা, বিশ্লেষণ করা, সমস্যা থেকে উত্তরণের দক্ষতা অর্জনের দীক্ষা শিক্ষকরাই দিয়েছেন। আজ আমরা যা কিছুই করছি সবই শিক্ষকরা আমাদের ভিতর যে প্রোগ্রাম ইনস্টল করে দিয়েছেন  তা কাজে লাগিয়ে করছি। আমরা কখনো কখনো বৈশ্বিক উচ্চতায় শিক্ষাগুরুকে ছাড়িয়ে যাই। কিন্তু সেই উচ্চতার ভিত শিক্ষকের হাতেই গড়া।

শিখনের শুরুতে বাই-সাইকেলকে ডানপিটে বালকের মতো মনে হয়। ডানে নিতে চাইলে বামে চলে। বামে নিতে চাইলে ডানে চলে। রাস্তায় পথচারী থাকলে সোজা তার দিকে ছোটে! কোন ভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। পথিক আত্মরক্ষার  জন্য এপাশ-ওপাশ করলে সাইকেল এপাশ-ওপাশ করে সোজা পথিকের গায়ে! আছাড় খেয়ে শরীরে যত্রতত্র আঘাত লাগে। পাদানিটা বিট্রয় করে। মনে হয় কেউ যেন গ্রিজ দিয়ে পিচ্ছিল করে রেখেছে। পা পিছলে যায়। জঙ্ঘাস্থির সাথে যেন জন্মান্তরের শত্রুতা পাদানির। রক্তাক্ত হয়ে যায়। কিন্তু যখন সাইকেল চালানোর কলাকৌশল আয়ত্বে এসে যায় তখন কী সহজ মনে হয়। হাতল ছেড়ে দিলেও সাইকেল দুষ্টুমি করে না। যেন মন বুঝে চলে। 

সাঁতার শেখার সময় বড়রা বলেন মুখ বন্ধ কর, নিঃশ্বাস বন্ধ রাখ, নাক দিয়ে শ্বাস নেও, হাত দিয়ে পানি ঠেলে সামনে যাও, পা ভাসিয়ে রাখ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু শিক্ষানবিশের অবস্থা হয় করুণ। মাথা উঁচু রাখতে রাখতে পা ডুবে যায়। পা সচল করতে গেলে মাথা ডুবে নাকে-মুখে পানি যায়। যখন সাঁতার কাটা আয়ত্ত্বে এসে যায়,তখন পানিতে নামলেই শরীর ভেসে থাকে। হাত-পাকে কোন কমান্ড দিতে হয় না। নিজেরাই যা যা করা দরকার তাই করে। কত সহজ পানিতে ভেসে থাকা। সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটার মতো শিক্ষা গ্রহণের দিনগুলোও মন থেকে বিস্মৃত হয়ে যায়। ফিকে হয়ে যায় শিক্ষাগুরুর মুখচ্ছবি। 

যিনি প্রথম সাঁতার শিখিয়েছেন তিনি হয়ত কোনদিন উপজেলা পর্যায়েই চ্যাম্পিয়ন হননি। কিন্তু আপনি আজ অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জিতেছেন।মনে করুন, আপনি যখন পানিকে যমের মতো ভয় পেতেন সেদিন তিনিই বলেছিলেন, ভয় পাওয়ার কিছু নেই। বিশেষ দক্ষতায় তুমি পানিতে ভেসে থাকতে পার।

যিনি আপনাকে নবম শ্রেণির গণিত পড়িয়েছেন তিনি হয়ত দ্বাদশ শ্রেণির উচ্চতর গণিতের কিছুই জানেন না। কিন্তু আজ আপনি রকেট বিজ্ঞানের জটিল জটিল অংক মিলাচ্ছেন, তার ভিত সেই শিক্ষকের হাতেই গড়া। আপনি জাঁদরেল আমলা। চাকরি বিধি আত্মস্থ, ম্যানার-এটিকেট  করায়ত্ব। আপনার স্কুল শিক্ষক হয়ত এসবের কিছুই জানেন না। কিন্তু আইন-বিধির মৌলিক পাঠ তিনিই দিয়েছিলেন। ধনি-গরীব, উঁচু-নিচু সবাইকে একই ইউনিফর্ম পরিয়েছেন, একই কক্ষে বসিয়েছেন। বলেছেন, সকল মানুষ সমান। শিক্ষক ইতিহাস, ঐতিহ্য,  সংস্কৃতি, দেশপ্রেমের চেতনায় উজ্জীবিত করেন, দেশকে ভালোবাসতে শেখান।

আজ যে বিজ্ঞানী মঙ্গল গ্রহে নবযান পাঠাচ্ছেন তিনি কোন শিক্ষকের কাছেই মহাকাশ বিজ্ঞানের মৌলিক পাঠ নিয়েছেন। যিনি সমুদ্র গভীরের রহস্য উন্মোচন করছেন, একদিন কোন শিক্ষকের কাছেই পাতালপুরীর গল্প শুনে তার অনুসন্ধিৎসা জেগেছিল।

যিনি আজ সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন তিনি হয়ত তার শিক্ষকের আবৃত্তি শুনে শুনে কবিতাকে ভালবেসেছিলেন। যিনি আজ গবেষণাকর্মে বিশ্ব নন্দিত তিনি কোন শিক্ষকের কাছেই শিখেছেন কিভাবে গবেষণা করতে হয়। আপনি হয়ত শিক্ষককে ভুলে গেছেন, কিন্তু শিক্ষক আপনাকে ভোলেননি। তিনি আজও ছাত্রদের আদর্শ ছাত্রের দৃষ্টান্ত দিতে আপনার কথা বলেন। আপনি তাকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন এটাই তার গৌরব। তাই মানুষের জীবনে পিতা-মাতার সাথে আরেকজন  গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হচ্ছেন শিক্ষক। এই তিনজনের সাথে কারো তুলনা চলে না।

সমাজ অন্ধকার রাতের সাথে তুলনীয়। চারিদিকে অন্ধকার। এখানে প্রকৃতি জগতের মতো কোন সূর্য ওঠে না। শিক্ষিত মানুষ সমাজ  আলোকিত করে। জ্ঞানের আলো, বিজ্ঞানের আলো, মানবতার আলো, সাম্যের আলো, ভ্রাতৃত্বের আলো, ন্যায়ের আলো। এই সকল আলোতে অন্ধকার দূর হয়। সমাজ সুন্দর  হয়। আমরা হয়ে উঠি সামাজিক জীব। সকল জীবের সেরা। প্রকৃতির রাজ্যের সাথে মনুষ্য সমাজের পার্থক্য গড়ে দেয় এই আলোর প্রদীপসম মানুষেরা। অনাদি কাল থেকে যিনি এই প্রদীপ জ্বালিয়ে যাচ্ছেন তিনি হচ্ছেন শিক্ষক। সমাজের বাতিঘর। সকল শিক্ষা-গুরুকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।

মোঃ মাহবুব হাসান জুয়েল
বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডার
প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান 
বরগুনা সরকারি মহিলা কলেজ

Powered by Froala Editor