Group Discussion




যুবসমাজের অবক্ষয়ের জন্য সমাজব্যবস্থাই দায়ী

গত ৮ অক্টোবর ঢাকার হাজারীবাগে ১০ তলা ভবন থেকে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। মীর জাওয়াদ বিন জসিম নামের ওই শিক্ষার্থী ঢাবির উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের ২০২১-২২ বর্ষে পড়তেন। শুধু একজন জাওয়াদ নয়, জানা গেছে, ২০২৩ সালের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত গড়ে ৪৫ দশমিক ১৩ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এত আত্মহত্যার কারণ কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর কারণ সমাজের স্রোতের সাথে তাল মিলাতে না পারা, সামাজিক চাপ মোকাবিলা না করতে পারা, অসুস্থ প্রতিযোগিতা ইত্যাদি। 
অবক্ষয় শব্দটির অর্থ কী? ক্ষয়প্রাপ্তি, নিম্নগতি, বিনাশ। যুবসমাজের ক্ষয়প্রাপ্তি ঘটছে, হচ্ছে বিনাশ। যার একটা ছোট উদাহরণ দেয়া হয়েছে। ছোট উদাহরণ এজন্য বলছি যে, যারা আত্মহত্যা করে ফেলেছে তাদের সংখ্যা গণনা করা যায় কিন্তু যারা প্রতিনিয়ত নিজেদের সাথে যুদ্ধ করে চলেছে কিংবা আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েও এগোতে পারছে না তাদের সঠিক সংখ্যা গণনা করা সম্ভব নয়। তবুও পরিসংখ্যান বলছে, প্রায়ই ৫০ শতাংশ তরুণ-তরুণী মানসিক অবসাদে ভোগে ও একবার হলেও তারা আত্মহত্যার কথা ভেবেছে। তাহলে সমাজ ব্যবস্থা এই তরুণ সমাজের অবক্ষয়ের জন্য কীভাবে দায়ী? 
 বর্তমান বিশ্ব দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে। প্রযুক্তির এই যুগে উন্নত বিশ্বের সাথে সমান গতিতে এগিয়ে চলতে গেলে আমাদের পরিবর্তন আনতে হবে চিন্তাধারায়, পরিবর্তন করতে হবে পুরানো ঘুণে ধরা নিয়ম। আমাদের দেশের তরুণ-তরুণীরা যখন প্রযুক্তির কল্যাণে কিংবা আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার জন্য নিজেদের পরিবর্তিত করতে চাচ্ছে তখনই বাঁধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে আমাদের সমাজের পুরানো মতধারা, গৎ বাঁধা নিয়ম ও কুসংস্কার। এর সাথে অন্যমাত্রায় যোগ হয়েছে প্রজন্মগত ব্যবধান। একুশ শতকে পৃথিবীতে হয়েছে অনেক পরিবর্তন, হয়েছে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, পৃথিবী এসেছে হাতের মুঠোয়। সমাজের প্রবীণ ব্যক্তিগণ এখনো অনেকেই সেই উন্নয়নের সাথে পুরোপুরি পরিচিত হতে পারেননি। কিংবা মেনে নিতে পারেনি আধুনিকায়ন। অনেকের চোখে এই আধুনিকায়ন সার্বিক অবক্ষয়। এই মতবিরোধের দোলাচালে পড়ে মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যুবক-যুবতীরা। তারা এগোতে পারেছেনা। শুরুতেই তাদের সামনে দিয়ে দেয়া হচ্ছে নিয়ম ও বিবেকের বেড়িবাঁধ। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের মত পার্থক্য, বাক স্বাধীনতায় বাঁধা, বিরোধ, বুঝতে না পারা এনে দিচ্ছে বিষন্নতা। 
 
 একজন শিল্পী যখন তার সম্পূর্ণ নিজের ভাবনা রঙ তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলেন তখন তা হয় সর্বশ্রেষ্ঠ, কিন্তু যখনই তাকে অনেক নিয়ম এবং শর্ত দেয়া হয় শিল্পকর্ম সৃষ্টির জন্য তখন তার শৈল্পিক স্বত্বা পুরোপুরি প্রকাশ পায়না। সমাজের যুবক-যুবতীরা প্রত্যেকে একেকজন সম্ভাবনাময় শিল্পী। তারা তাদের নিজেদেরকে প্রকাশ করতে চায়, নতুন কিছু করতে চায়, পরিবর্তন আনতে চায়। তাদের সেই সত্ত্বা প্রকাশে যখন বাঁধা দেয়া হয়, নিয়মের বেড়াজালে আটকে রাখা হয়, তখন তাদের অবক্ষয় ঘটে। এছাড়া দুর্নীতি কবলিত সমাজব্যবস্থা যুবসমাজের উন্নয়ের অন্যতম প্রধান অন্তরায়। ছোট থেকে শিখে আসা মূল্যবোধের প্রয়োজনীয়তা কিংবা পরিবার থেকে প্রাপ্ত শিক্ষার প্রতিফলন যখন তারা বাইরের দুনিয়ায় দেখতে পায় না তখন জীবনের প্রতি চলে আসে ঘৃণা, অবজ্ঞা, অবসাদ। এরূপ সমাজব্যবস্থার ঘূর্ণিতে নিজেদের হারিয়ে ফেলছে যুবসমাজ। 
 
 বর্তমান সময়ে আত্ম নিয়ন্ত্রণ একটি বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রযুক্তির আধুনিকতা আমাদের এনে দিয়েছে উন্নয়নের জোয়ার তেমন পরিচয় করিয়ে দিয়েছে অন্ধকার জগতের সাথে। এই সময়ের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে আধুনিকতা থেকে ভালো উপকরণ আস্বাদন করে নেয়া। একটি উদাহরণ হচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর অত্যাধিক নির্ভর হয়ে পড়া, ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহার না জানা। এর ফলে হচ্ছে ব্যক্তিগত সম্পর্কের সমস্যা, মূল্যবান সময় নষ্ট, নেশা জাতীয় দ্রব্যের প্রতি নির্ভরতা ও সহজলভ্যতা, বই বিমুখীতা, নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি আকর্ষণ ইত্যাদি। এখানেই আসে আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রসঙ্গ। প্রযুক্তি আমাদের মস্তিষ্ক নিয়ে ক্রমাগত পরীক্ষা চালিয়ে যাচ্ছে। যুবকরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। মস্তিষ্কের এই খেলায় তারা নিজেদের হারিয়ে ফেলছে। তারা বুঝতে পারছে যে তারা ঠিক কাজ করছে না কিন্তু নিজেদের নিয়ন্ত্রণে তারা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। এছাড়া, ত্রুটিপূর্ণ শিক্ষাব্যবস্থা, চাকরির বাজারে অসুস্থ প্রতিযোগিতা যুবসমাজকে অন্ধকারে ঠেলছে। বর্তমানে অপসংস্কৃতি চর্চা যুবসমাজের অবক্ষয়ে বড় ভূমিকা পালন করছে। বিশ্ব যখন হাতের মুঠোয়, তখন খুব সহজেই অন্য দেশের সংস্কৃতি চর্চা করা সম্ভব। এবং অপসংস্কৃতি আত্মস্থ করার ফলে যুবসমাজ দ্বিধায় পড়ে যাচ্ছে এবং নিজ দেশের সংস্কৃতির সাথে অন্য দেশের সংস্কৃতির মিশ্রণে তারা নিজেদের মূল হারিয়ে ফেলছে। অবক্ষয়ের আরেকটি কারণ হচ্ছে সুস্থ বিনোদনের অভাব। অত্যাধিক প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়ায় যুবসমাজ বাইরে বের হতে পারছে না। তাদের যোগাযোগ দক্ষতা কমে যাচ্ছে, এর ফলে তাদেরকে গ্রাস করছে একাকিত্ব। 
 
 যুবসমাজের অবক্ষয় এখন বর্তমানে একটি প্রধান চিন্তার বিষয়। একটি দেশের যুবসমাজ যখন ভেঙে পড়ছে তখন সেই দেশের উন্নতির মাত্রা কমে যাবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে, যুব সমাজের অবক্ষয়ের জন্য সমাজব্যবস্থা দায়ী? নাকি একটি নৈতিক, আদর্শ সমাজ গঠনে যুবসমাজের অবক্ষয় রোধ করা জরুরি? আমার মতে, দু’টিই সঠিক। একটি অপরটির পরিপূরক। একটি দেশের সমাজব্যবস্থা যখন যুবসমাজকে এগিয়ে যেতে বাঁধা দেয় তখন সেই সমাজের আরো অবনতি হয়, দেশের উন্নয়নে বাঁধা আসে। তাই, এসকল সমস্যার প্রতি জোরদার নজর প্রদানের মাধ্যমে এবং সমাজের সকলের সুষ্ঠু পদক্ষেপ গ্রহণ করে দেশকে, এই যুবসমাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব।